ইসলামের দৃষ্টিতে রত্ন-পাথর ও তার ব্যবহার


মানব জাতির সার্বিক মঙ্গলের জন্য ইসলাম বস্তু জগতের সব রকম কল্যাণ ও অকল্যাণের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। জ্ঞান রাজ্যের সকল শাখা সম্পর্কে ইসলামের মৌল ও একমাত্র গ্রন্থ আল কুরআন হচ্ছে সুবিসৃত প্রামান্য দলিল। এই আল-কুরআন সমগ্র মানব-জাতির জন্য প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ে সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে আলোকপাত করেছে। তবে কিছু জটিল ও অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়ে কুরআন জ্ঞানগর্ভ বিবরণ দিয়েছে যা সাধারণ মানুয়ের নিকট দুর্বোধ্য। এমনি এক বিষয় হচ্ছে রত্ন-পাথর প্রসঙ্গ। ইসলামের আবির্ভাব কালে হজরত আলী (রাঃ) হজরত ওসমান (রাঃ) সহ তদানীন্তন নেতৃস্থানীয় আরব অভিজাত ব্যক্তিবর্গের হাতে মহামূল্যবান রত্ন-পাথর শোভা পেলেও ইসলাম অজ্ঞাতকারণে রত্ন-পাথর সম্পর্কিত বিষয়টি অত্যন্ত প্রচ্ছন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সঃ) এর হাতে আকীক পাথর শোভা পেলেও আমরা মহামূল্যবান রত্ন-পাথরের ব্যবহার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাই না। তবে এর অর্থ এই নয় যে, ইসলাম রত্ন-পাথর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। ইসলাম বস'র দ্রব্যগুণ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব (Scientific theory) উপস্থাপন করেছে। তাই সৃষ্টির এক অপরূপ প্রকাশ রত্ন-পাথরের দ্রব্যগুন সম্পর্কেও ইসলাম আমাদেরকে অবহিত করেছে। শুধু এর উপরই অতিরিক্ত গুরুত্বারোপ অর্থাৎ শেরেকি ভাবধারা আরোপের ব্যাপারে ইসলাম সকলকে হুশিয়ার করে দিয়েছে। এ কথার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, রত্ন-পাথরের ‘রত্নগুণ’ হচ্ছে এক জিনিস আর এর উপর শেরেকি ভাবধারা আরোপ হচ্ছে অন্য জিনিস। এ প্রসঙ্গে একটি বিষয়ের উল্লেখ প্রণিধানযোগ্য, হজরত মুহাম্মদ (সঃ) - এর আবির্ভাবের সাথে সাথে তদানীন্তন বিপর্যস্ত আরবজাতির ভাব জগতে সৃষ্টিকর্তা এবং সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে যে ভাবধারার সৃষ্টি হয় সে প্রেক্ষিতে রত্ন-পাথরের গুণাগুণ সম্পর্কিত বিষয়টি খুব বেশি প্রাধান্য পায়নি। পরবর্তীকালে ইসলামের পূণর্জাগরণ কালে(Islamic Renaissance) রত্ন-পাথর সম্পর্কিত বিষয়টি চিন্তাবিদগণের নিকট গবেষণার খোরাক হয়ে দাঁড়ায়। যখন ইসলামের উদার, উজ্জ্বল দীপ্তিতে জ্ঞানের জগতে ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়েছে। তাই এ সময় চিন্তাবিদগণ ধর্ম ও দর্শন চিন্তার পাশাপশি রত্ন-পাথর সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। এ সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক ও শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা এ লেখার প্রারম্ভে উল্লেখ করা হয়েছে।
রত্ন-পাথরের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ পরোক্ষভাবে আমাদের নিকট এর মাহাত্মা মূর্ত করে তোলে। তাই একটি কুরানিক ব্যাখ্যার উল্লেখ একান- প্রয়োজন। সূরা আর রহমান এর ১৯ ও ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“তিনি প্রবাহিত করেন দুই দরিয়া (সমুদ্র) যারা পরস্পর মিলিত হয় ------উভয় দরিয়া (সমুদ্র) হতে উৎপন্ন হয় মুক্তা ও প্রবাল। তোমরা আমার কোন দানকে অস্বীকার করবে” এরপর কুরআনের অন্যত্র বর্ণিত রয়েছে যে, পৃথিবীতে আল্লাহ্‌তালা যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তা যে কোন ভাবেই হোক মানুয়ের কল্যাণে আসে। মহান আল্লাহ প্রদত্ত রত্ন-পাথর যেমন-জমরুদ, ইয়াকুত, মুক্তা, হীরা, প্রবাল, পোখরাজ ইত্যাদি আল্লাহ্‌র দান এগুলোকে কি আমরা প্রত্যাখ্যান করতে পারি? ইসলামে রত্ন-পাথরের ব্যবহার কতটুকু গ্রহণীয় তার প্রমাণ পাই নবী, রসুল এবং বিশিষ্ট সংস্কারক ও পন্ডিত ব্যক্তিবর্গের রত্ন-পাথর ব্যবহারের দ্বারা। যেমন- হজরত আলী (রাঃ) অন্যান্য রত্নের সাথে ইয়াকুত (Ruby) ব্যবহার করতেন। হজরত আলী (রাঃ) এর মতে যে ইয়াকুত ছিল তার উপর বিশেষ আয়াত লেখা ছিল। ‘মাকারিমূল আখলাক’ এর মধ্যে উল্লেখ আছে যে, হজরত ইমাম মূসা কাজিম (আঃ) এর হাতে যে ফিরোজা (Turquise) রত্ন ছিল তার উপর “আল্লাহ-মালিক” লেখা ছিল। আরও জানা যায় হজরত আলী (রাঃ) এবং হজরত ওমর (রাঃ) যখন যুদ্ধে যেতেন তখন এই ফিরোজা রত্ন হাতের বাজুতে অথবা গলায় পরিধান করতেন। কারণ ইহা বিভিন্ন দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করতে সক্ষম বলে কথিত আছে।
রত্ন-পাথর শুধু যমীন বা পৃথিবীর ভূভাগেই নয়, আকাশমন্ডলী এবং বেহেশ্তেও রয়েছে
হযরত কা আহ্বার (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহতাআলা বেহেশতে ইয়াকুত রত্নের মহল তৈরী করেছেন, প্রত্যেক মহলে সত্তর হাজার কামরা। ইমাম গায্যালী (রহঃ) এর মুকাশাফাতুল কুলূব গ্রন্থে জানা যায়, কথিত আছে- ষষ্ঠ আসমান জওহর তথা মহামূল্য পাথর দ্বারা গঠিত। সপ্তম আকাশ হচ্ছে মহামূল্য ইয়াকুত লাল বর্ণের প্রবাল পাথর দিয়ে তৈরী। আর আসমানেই রয়েছে বাইতুল মামুর যার কোন চতুষ্টয়ের একটি লাল ইয়াকুত রত্নের, দ্বিতীয়টি সবুজ পান্না রত্নের। আরো বর্ণিত আছে- বাইতুল-মামুর মহামূল্য আকীক পাথরের তৈরী। প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা এর তওয়াফ করে
এতক্ষণ ইসলামের দৃষ্টিতে রত্ন-পাথর তার ব্যবহার সম্পর্কে যে বিশ্লেষণ পেশ করা হয়েছে তার দৃঢ় তত্ত্ব উন্মোচনের বিষয়টি ততো সহজ নয়। কারণ বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য অনুভূতির তীব্রতা আর নিরলস সাধনা প্রয়োগ প্রয়োজন। ভাসা ভাসা উপলব্ধি এবং মামুলি কিছুটা চর্চা করেই এর মৌল তত্ত্ব উদঘাটন সম্ভব নয়। কারণ আমরা জানি সাগর গর্ভে যে বিপুল রহস্যরাজি লুকিয়ে রয়েছে তা অনুধাবনে আগ্রহী ব্যক্তি যদি হিমালয় শীর্ষে বসে গবেষণা কর্ম শুরু করেন তবে তার পক্ষে গবেষণার ফল লাভ আশা করা যেমন হাস্যকর, তেমনি রত্ন-পাথর সম্পর্কে তাত্ত্বিক প্রায়োগিক জ্ঞান অর্জন না করেই সম্বন্ধে বিচার বিশ্লেষণ অসম্ভব। তাই আসুন আমরা উদ্বেগহীন শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য ইসলাম প্রদর্শিত নির্দেশনা অনুযায়ী রত্ন-পাথর ব্যবহারে প্রবৃত্ত হই। প্রকৃত পক্ষে রত্ন-পাথরের গুণাগুণ অনস্বীকার্য। যুগ যুগ ধরে মানবজাতি এর ফলাফল পেয়েছে অনন্ত কাল পাবে।
অতঃপরদ্রব্যগুণ অনস্বীকার্য ব্যাপারে পন্ডিত শিক্ষিত সমপ্রদায়ের মধ্যে কোন দ্বি-মতের অবকাশ নেই। সুতরাং কোরআন, পুরাণ, বিজ্ঞান, আয়ুর্বেদ, হেকিমী জ্যোতিষ বিজ্ঞানের আলোকে বিচার বিশ্লেষণে এবং নিজ অভিজ্ঞতায় বলা যায়- রত্ন ভস্ম অমূল্য ঔষধ; রত্ন মানব মনে আনন্দ দানকারী, শরীর স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য, বীর্য যৌবন বৃদ্ধির সহায়ক
শত্রু, হিংস্র জন' আক্রমণ, দৈব-দুর্বিপাক, রোগশোকে রক্ষাকারী অর্থ সম্পদের সহায়ক এবং স্রষ্টার সৃষ্টি রহস্য অনুভব করার এক অনুপম মাধ্যম। ধর্মীয় পৌরাণিক দৃষ্টিতে রত্নের ব্যবহার
খৃষ্টান ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেল-হীরা, আকীক, পোখরাজ, নীলা, জ্যামোনিয়া প্রভৃতি রত্ন-পাথরের বর্ণনা আছে। বিশেষ করে ওল্ড টেষ্টামেন্টেজেনেসিসগ্রনে' আলোচনায়ব্রিমষ্টোননামক পাথরের কথাও জানা যায়।
অথর্ববেদের বর্ণনা থেকে জানা যায় অশুভ বা বিরুদ্ধ গ্রহের প্রতিকারের উপায় মাত্র দুটি। প্রথম হলো ঈশ্বর আরাধনা-দ্বিতীয় হলো মহামূল্য গ্রহ রত্ন ধারণ। (অর্থাৎ রত্ন-পাথর গ্রহদের প্রভাবিত করে মানুষের কল্যাণ আনয়ন করে দৈবদুর্বিপাক থেকে রক্ষা করে)
মনুসংহিতায় বলা হয়েছে- সুসজ্জিত পোষাকে পবিত্র ভাবে রত্ন-পাথর যথাযথভাবে ধারন করলে জীবজন্তু অনিষ্ট থেকে তীব্র কামের উগ্রতা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এমন কি সবার শ্রদ্ধা লাভ করা যায়। ধন, সম্পত্তি, সুখ-শান্তি বৃদ্ধি পায় এবং রমনীকুল বশীভূত হয়। রত্নচূর্ন ভক্ষণে শরীর চেহারায় শ্রীবৃদ্ধি ঘটে, বিষ ক্রিয়া নষ্ট হয়
অগ্নি পুরাণ মতে- প্রত্যেকের রত্ন ধারণ করা কর্তব্য বলে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। শী্রকৃষ্ণেরস্ব্যমন্তকমণি নারায়ণেরকৌন্তভ মনিরকথা হিন্দু ধর্মবম্বী মধ্যে সর্বজন বিদিত
কুবের, রাবণ,দুর্যোধন, কংস আরো অন্যান্য রাজন্যবর্গের পভাব প্রতিপত্তির মূলে রত্ন ধারণের ইতিহাস পাওয়া যায়। মহাশক্তি চন্ডী নানা প্রকার রত্ন মন্ডিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অসুর নিধন করতেন।
প্রাচীন ধর্ম গ্রন্থগুলোতে বিশেষ করে বেদ, পুরাণ, রামায়ণ মহাভারত প্রভৃতিতে রত্ন-পাথার ধারণ বা ব্যবহার করার কথা উল্লেখ রয়েছে
আর্য সমাজের সৈনিকরা যুদ্ধে যাওয়ার পূর্বক্ষণেই বিভিন্ন প্রকার রত্ন-পাথর ধারণ করে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে যেতেন বলেও জানা যায়।
মহাভারতে জানা যায় অশ্বমেধ যজ্ঞের পূর্বে অশ্বরক্ষক অর্জুন তাঁর অচেনা পুত্র বভ্রু বাহনের দ্বারা যুদ্ধে নিহত হলে পত্নী নাগকন্যা উলুপী পিতৃ প্রদত্ত রত্ন দ্বারা স্বামীর জীবন রক্ষা করেন।

আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে রোগ-ব্যাধির নিরাময় বিভিন্ন রোগের জন্য বিভিন্ন রত্নভস্ম ব্যবহার বা ভক্ষনের কথা বলা হয়েছে। আয়ুর্বেদশাস্ত্র মতে রত্ন ভস্ম দ্বারা যে রোগ-ব্যাধি নিরাময় হয় তাআযুর্বেদ চিকিৎসা শাস্ত্রের সাফল্যই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্রাচীন কালের এই আয়ুর্বেদ শাস্ত্র আজ বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে স্বীকৃত
আয়ুর্বেদাচার্য্য, সুশ্রুতাচার্য্য, চরক রত্ন-পাথরের রত্ন ভস্মের সম্পর্কে এদের গুণাগুণ বিভিন্ন প্রকার রোগ-ব্যাধি কিভাবে নিরাময় করে তার বর্ণনা করেছে। মহাভারত পুরাণের যুগ হতেই রত্ন-ধারণের রত্ন ভস্ম ভক্ষনের প্রথা চলে আসছে। ভেষজ বিজ্ঞানে চরক সুশ্রুতের দ্বারা ইহার ক্রম ধারা আজও চলছে

1 comments:

  1. নামহীন says

    What a material of un-ambiguity and preserveness of valuable experience concerning unexpected feelings.


    My website ... awebcafe.com


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন